আজকাল পত্রিকা, শারদ সংখ্যা ১৪১৯। সামান্য সম্পাদিত।
শ্ম্ভু মিত্রকে কেবল মাত্র বাংলার মঞ্চ জগতের এক অবিস্মরণীয় প্রতিভা বলে মনে করলে অবশ্যই সেই পরিচয় অসমাপ্ত থেকে যাবে। তাঁর অনন্যসাধারণ অভিনয় ক্ষমতাকে ছাপিয়ে উঠেছিল বাংলা নাটকে যে মৌলিক ধারা তিনি প্রণয়ন করেছিলেন। তাঁর বাচন ভঙ্গী থেকে শুরু করে অভিনয় শৈলী, মঞ্চের উপর তাঁর চলন — সবই ছিল অভূতপূর্ব। তাঁকে নকল করেছে হয়তো অনেকেই, খুব একটা সফল ভাবে এমনটাও বলা চলে না, কিন্তু তিনি নিজে ছিলেন একেবারেই স্বয়ম্ভু। কাজেই এই মানুষটির ভূমিকায় মঞ্চে অভিনয় করা যে খুব একটা সহজ কর্ম নয় এ তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু তবু যে এই অমর নাট্য ব্যক্তিত্বটির খবরাখবর নাট্য রঙ্গ গোষ্ঠী মঞ্চে পুনর্বার নিয়ে আসার প্রয়াস পেয়েছে এটা নিঃসন্দেহে সুখবর। সেই একই সঙ্গে অবশ্য একবার চিন্তা করার প্রয়োজন আছে আদৌ এই কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব কিনা। অনিবার্য ভাবেই গ্রিক পুরাণ থেকে এটলাস পর্বতপুঞ্জের মহাকাশ ঘাড়ে করে দাঁড়িয়ে থাকার কাহিনিটি মনে এসে যায়। কাজটি হারকিউলিসকেও অল্প কিছুক্ষণের জন্য করতে হয়েছিল, কিন্তু তিনিও এটলাসের ঘাড়ের আকাশ ঘাড়ে ফিরিয়ে দিয়েই পলায়ন করেছিলেন। অবশ্য শ্রী শম্ভু মিত্র নাটকের প্রযোজকরা এখনও পলায়নের পথ অবলম্বন করেননি। আর এটা নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখে।
গ্রিক পুরাণের প্রসঙ্গটা স্বাভাবিক ভাবেই মনে এসে গেল। সেটা কেবল মাত্র শ্ম্ভু মিত্রর রাজা অয়েদিপাউস নাটক প্রযোজনার পরিপ্রেক্ষিতে নয়, যদিও সে কথায় তো পরে ফিরে আসতেই হবে। অন্য একটি কারণেও গ্রিক নাট্য-ধারার সঙ্গে নাট্যকার ও প্রধান অভিনেতা শ্রী সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটকটির একটি যোগাযোগ লক্ষ্য করা যায়। গ্রিক নাট্য শাস্ত্রে যে ভাবে নাটকের চরিত্ররা ভাগ্য বা নিয়তির শিকার মাত্র, প্রায় সেই একই ভাবে শ্রী শম্ভু মিত্র নাটকেও নিয়তি বারে বারে ঘুরে আসে। একটি মানুষের আপোশ-বিহীন শুদ্ধতার অনুসন্ধান নিয়েই এই নাটকের কাহিনি। নিয়তির সঙ্গে নিষ্ঠুর সংঘাতের ফলে মানুষটি ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়, কিন্তু আপোশ তবু সে করে না। করে না, আবার করেও, যেমনটা ঘটেছিল কল্প জগতের বাইরে গ্যালেলিওর জীবনে।
অয়েদিপাউসের মতই গ্যালেলিওর কাহিনিও অপ্রাসঙ্গিক নয়। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত Dava Sobel রচিত Galileo’s Daughter (Walker and Co.) গ্রন্থে যে ছবিটি পাওয়া যায় তাতে ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের বীভৎস বিচার (Inquisition) সহ্য করার পর ভগ্ন স্বাস্থ্য, অতি প্রবীণ গ্যালেলিওকেও হয়তো বা শেষ পর্যন্ত আপোশ করতেই হয়েছিল। প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী তিনি যদিও বিচার সভায় স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে সূর্যই পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে, কিন্তু তারপর ফিসফিস করে নাকি বলেছিলেন — Nevertheless it does। অর্থাৎ যাই তোমারা বল না কেন, পৃথিবীই ঘোরে সূর্যকে ঘিরে। Dava Sobel মনে করেন এটা পরবর্তী যুগের মানুষের মন গড়া কথা মাত্র। Spanish Inquisition থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া এক বৃদ্ধ মানুষের পক্ষে এমন উক্তি করা সম্ভবই ছিল না। Dava Sobel-এর বই সম্পর্কে প্রায় এই উক্তিই আমরা দেখতে পাই উইকিপিডিয়াতে। উক্তিটি হল — Galileo’s Daughter exposes readers to his story – not just as a brilliant scientist, but also as a human being struggling with the boundaries of belief, religion and the idea of “truth” during his time। আর Bertolt Brecht-এর গ্যালেলিও নাটকে শম্ভু বাবুর অভিনয় থেকেও প্রায় এই জাতীয় একটা বার্তাই যেন বেরিয়ে এসেছিল।
শ্রী শম্ভু মিত্র নাটকটি নিয়ে চিন্তা করতে গেলে অয়দিপাউস বা গ্যালেলিও প্রসঙ্গ এড়ানো যেমন কঠিন, তেমনই অসম্ভব এড়িয়ে যাওয়া শম্ভু বাবুর নিজের রচিত নাটক চাঁদ বণিকের পালা-কে। আর নাট্য রঙ্গ সংস্থা এ ব্যাপারটা নিয়ে খুব পরিষ্কার ভাবেই অবহিত। প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করার আগেই দর্শকের হাতে যে প্রচারপত্রটি ধরিয়ে দেওয়া হয় তার প্রথম পাতাতেই চাঁদ বনিকের শিবাই-এর সন্ধানের উল্লেখ রয়েছে। নাটকটি দেখার পর এবং সেটি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার পর একটি সিদ্ধান্ত কোনোমতেই এড়ানো যায় না। আর তা হল শ্রী শম্ভু মিত্র নাটকটি যে মূল স্তম্ভর উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটি শম্ভু বাবুর নিজের রচিত নাটক চাঁদ বণিকের পালা। শম্ভু বাবু এই নাটকটি কখনই মঞ্চস্থ করেননি, কিন্তু বেশ কয়েকবার শ্রুতিনাটকের আশ্রয়ে পরিবেষণ করেছেন। শেষবার পরিবেশিত শ্রুতিনাটকটির একটি রেকর্ডিং আছে। নাটকের অন্তে শম্ভু বাবু শ্রোতাদের জানাচ্ছেন যে যদিও তিনি কোনোদিনও সাবেকি থিয়েটারের সাহায্যে নাটকটি উপস্থাপিত করেননি, তবুও শ্রুতিনাটকের আকারে উনি ভবিষ্যতের মানুষের জন্য নাটকটি রেখে গেলেন। যদি কারও ভাল লাগে, যদি নাটকটি মঞ্চস্থ করার ইচ্ছা জাগে, তবে হয়তো বা রেকর্ডিংটি কাজে লাগতেও পারে।
মনসা মঙ্গল খ্যাত চাঁদ বনিকের সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। সম্প্রতি কালে এমন কী টিভি সিরিয়ালের পর্দাতেও চাঁদ বণিক আবির্ভূত হয়েছেন। তবুও এখানে তাঁর কাহিনিটা একটু স্মরণ করে নিলে নাট্য রঙ্গর সুমহৎ প্রয়াসটির মর্মোদ্ধার করতে সুবিধা হবে। চাঁদ ছিলেন অবিচল এক শিব ভক্ত যিনি অসংখ্য প্রলোভন সত্ত্বেও মনসার ভক্ত হতে অস্বীকার করেন। কিন্তু শিব তাঁর এই পরম ভক্তটিকে হয়তো বা পরীক্ষা করেই চলেন, তাঁর অবিচলিত ভক্তির জন্য পুরস্কার মেলে না কিছুই। এদিকে মনসার পূজারীদের জাগতিক সমস্ত চাহিদাই মিটে যায়। চাঁদকে ভক্ত হিসেবে না পেয়ে মনসা নানা শাস্তি বিধান করেন, চাঁদের ছেলেদের একটি একটি করে সর্প দংশনে মৃত্যু হয়। পড়ে থাকে কেবল সর্বকনিষ্ঠ লখিন্দর। সেই লখিন্দরকেও তার বিবাহের রাতে সাপের বিষে প্রাণ হারাতে হয়। কিন্তু তার নব বিবাহিতা পত্নী বেহুলা এই অবিচার মেনে নেয় না। তার মৃত স্বামীর শবদেহের সহযাত্রী হয়ে সে সুবিচার দাবি করে গিয়ে হাজির হয় একেবারে যম রাজার গৃহে। মনসা সেখানে লখিন্দর তো বটেই, চাঁদের অন্যান্য পুত্রদেরও জীবন ফিরিয়ে দেন। তব একটি শর্তে। চাঁদকে মনসার পূজা করতে হবে। চাঁদ শেষ পর্যন্ত মনসার শর্ত মেনে নেন, কিন্তু বাঁ হাতে নৈবেদ্য এগিয়ে দিয়ে সবটুকু আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেন। এতদ্সত্ত্বেও মনসা চাঁদের পুত্রদের জীবন দান করেন এবং চাঁদকেও তাঁর হৃত সমস্ত সম্পদ ফিরিয়ে দেন।
শম্ভু বাবুর নিজের সৃষ্টি চাঁদ বণিকের কাহিনি কিন্তু অনেকটাই অন্য পথে চলে। চলতি কাহিনির মতই চাঁদ শিবের ভক্ত এবং মনসাকে পূজা দিতে অনিচ্ছুক। এবং মনসা একের পর এক অভিশাপে বণিকের জীবনকে শ্মশান ভূমিতে পরিণত করে দিতে থাকেন। শিব কোনও অদৃশ্য লোক থেকে চাঁদের জীবনের নির্মম পরিণতি হয়তো দেখেন, হয়তো দেখেন না। কেবল চাঁদের অটল ভক্তি আর যাই হোক শিবকে টলায় না। এই পর্যন্ত কাহিনিতে বিশেষ কোনও তফাত নেই। তফাতটা দেখা দেয় যখন বেহুলা ফিরে আসে লখিন্দরকে বাঁচিয়ে তুলে। চাঁদ তখন বৃদ্ধ, দুর্বল তাঁর শরীর, তাঁর শিবের প্রতি অটল ভক্তির আদৌ কোনও অর্থ ছিল কিনা তা নিয়েও হয়তো সন্দিহান। কোথাও যেন গ্যালেলিওর ছায়া এখানে দেখা যায়। পাওয়া যায় নিরপরাধ অয়দিপাউসের বিভীষিকাময় জীবনের ছায়া। বেহুলার অনুরোধে তিনি মনসাকে পূজা দিতে যান এবং প্রাচীন কাহিনির মতই ব্যবহার করেন প্রসারিত বাঁ হাতটি। অর্থাৎ বিপ্লবী তখনও অন্তরের কোথাও জেগে রয়েছে।
চাঁদ যখন মনসার মন্দিরে চলে গিয়েছেন, তখন বেহুলা দর্শকদের আসল কাহিনিটি শোনায়। সে যা চেয়েছিল তা মনসা তাকে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু লখিন্দরের প্রাণ সে বিনা মূল্যে ফিরে পায়নি। পেয়েছে তার নারীত্বের মর্যাদার বিনিময়ে। বেহুলাকে একেবারেই “বাজারি অওরত” হয়ে নারী মাংসলোভী পুরুষদের সামনে নওটঙ্কি নাচ নেচে দেখাতে হয়েছে। তার সমস্ত সরলতাকে বিসর্জন দিয়ে তবেই লখিন্দরকে সে বাঁচিয়ে তুলেছে। কিন্তু এখন তার নিজের জীবনের কোনও অর্থ আর আছে কি? সংবাদটা লখিন্দরের কানেও পৌঁছায়। অপমানের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে তারা আত্মহত্যার আশ্রয় নেয়। আর চাঁদ মনসার সঙ্গে আপোশ করে ফিরে এসে দেখেন তিনি সর্বস্ব হারিয়েছেন। সমস্ত জীবন শিবের ভক্ত থেকেছেন তিনি কিন্তু শিব তাঁকে কেবল পরীক্ষাই নিয়েছেন। আর যেদিন তিনি শিবকে ছেড়ে মনসার জাগতিক ভোগ বিলাসের রুচিহীনতাকে ধরতে গেলেন সেদিন শূন্যতা ছাড়া কিছুই পেলেন না। এমন কী নিজের আত্মমর্যাদাবোধও হারালেন।
শেষ অবধি শম্ভু বাবুর চাঁদ বণিকের পালা এক কালের এবসার্ড নাটকের (absurd drama) ধার ঘেঁষে চলে গিয়েছে। অস্তিত্ববাদ দর্শনের পথ ধরে নাটকটি যেন জিজ্ঞাসা করছে মনুষ্য জীবনের আদৌ কোনও অর্থ আছে কি? আবার এমনও হতে পারে যে তিনি অন্য একটি বার্তা আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আর তা হল আদর্শে বিশ্বাস রাখার জন্য জাগতিক অর্থে কোনও প্রতিদান নেই। বিশ্বাসের প্রতিদান বিশ্বাস নিজেই। এই সত্য অনুভবে ব্যর্থ যে মানুষ তার জন্য যে যশ প্রতিষ্ঠা সাজানো থাকে সে শূকরী বিষ্ঠারই সমতুল্য। এমন হতেও পারে যে গ্রিক পুরাণের Sisyphus-এর সমস্যাটাও ছিল কতকটা এমন ধরণেরই। Sisyphus আপোশ না করে অনন্তকাল ধরে, হয়তো আজ এই মুহূর্তেও, পর্বত শৃঙ্গে পাথর তোলার ব্যর্থ প্রয়াস পেয়ে চলেছেন। আর চাঁদ মাটির মানুষ বলে শেষ পর্যন্ত আপোশ করছেন বটে কিন্তু বৃথাই সেই আপোশ।
নাট্য রঙ্গর শ্রী শম্ভু মিত্র নাটকটিকে অবশ্য চাঁদ বণিকের পালার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না, কিন্তু আগেই যে কথা বলা হয়েছে, নাট্যকার চাঁদ বণিকের পালা দিয়ে নিঃসন্দেহে প্রভাবিত হয়েছেন। শম্ভু মিত্র এই নাটকের মুখ্য চরিত্র আর বারবারই যে নির্মম সত্যটা উঠে আসে নাটকের বিভিন্ন দৃশ্যে তা হল মর্ত্যের মানুষের জন্য অমর্ত্যের সাধনার পথটি অতিরিক্ত বন্ধুর।
পর্দা ওঠার সময় মঞ্চ ঢাকা আলো আঁধারিতে। হালকা আবহ সঙ্গীত (স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর সৃষ্টি) যখন আস্তে আস্তে চোখকে মঞ্চের আবছা অন্ধকারের সঙ্গে অভ্যস্ত করে আনে তখন যে সেটটি দৃশ্যমান হয় (কৌশিক সেনের সৃষ্টি) সেটি আড়ম্বরবিহীন কিন্তু রুচিসম্পন্ন। একেবারে পিছনে সমস্ত মঞ্চের দৈর্ঘ্য জুড়ে একটি পুরাকালের দাঁড়বাহী বাণিজ্যিক নৌকা। মঞ্চের সামনে ডান দিকের (stage right) উইংসে একটি চক্র বা ring। বাঁ দিকে (stage left), আবারও একেবারেই সামনে তিনটি জিনিস চোখে পড়ে। প্রথম, ত্রিভুজের শীর্ষ কোণের অনুকরণে সংযুক্ত দুটি দণ্ড। এই কৌণিক শীর্ষটি উলটো দিকের সুডৌল বৃত্তটির সঙ্গে যেন একটা contrast-এর দিকে নজর কাড়ে। বৃত্তটি মনে হয় বিরোধশূন্যতার প্রতীক, আর তীক্ষ্ণ কৌণিক শীর্ষটি যেন প্রচলিত রীতির সম্পর্কে তীব্র অনীহার লক্ষণ। বাঁ দিকে দ্বিতীয় যে স্টেজ prop-টি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেটি একটি লম্বা কাঠের পোলের উপর রক্ষিত লেটার বক্স। আর তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ আসবাবটি হল সুবিখ্যাত চিত্রকার Salvador Dali-র Persistence of Memory ছবির আদলে তৈরি একটি বেঁকা তেড়া দেয়াল ঘড়ি।
ঘড়িটি প্রথম থেকেই যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে এই নাটকে অনেক স্মৃতিকথা উঠে আসবে। এমন সব কাহিনি যেগুলোর একাধিক ব্যাখ্যা হয়তো থাকতে পারে। এমন সব ব্যাখ্যা যেগুলোকে প্রয়োজনে নতুন আদল দেওয়াও সম্ভব। ঘড়ির আকার বলে দিচ্ছে সেটা কঠিন কোনও পদার্থ দিয়ে তৈরি নয়, তাকে টেনে লম্বা করা চলে, চেপে ক্ষুদ্র করে দেওয়াও যায়। ঠিক যেমনটা হয়ে থাকে বেঁচে থাকা স্মৃতির ক্ষেত্রেও। কেবল কেমন আকারে স্মৃতি ফিরে ফিরে আসবে সেটা স্পষ্ট নয়, Dali-র ছবির মতই।
লেটার বক্সটির ব্যবহারে পরে ফিরে আসব। মঞ্চের মাঝখানে একটি বেদি আর সামনে দুপাশেও দুটি ছোট আকারের বেদি। কেন্দ্রে অবস্থিত বেদিটির চারপাশে নাটকের কয়েকটি শোকাচ্ছন্ন চরিত্র বসে আছে। মনে হয় যেন সদ্য দাহ করা হয়েছে তাদেরই কোনও প্রিয়জনকে ঐ বেদির উপরেই, কিন্তু তাঁরই আত্মাকে হয়তো প্ল্যানচেটের সাহায্যে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা চলছে। চরিত্রগুলি যখন একে একে কথা বলে ওঠে তখন আবার একটা নতুন সত্য উঠে আসে। এরা সকলেই শম্ভু বাবু পরিচালিত নাটকের চরিত্র, এমন কী চাঁদ বণিকের পালা থেকে বল্লভাচার্য ও বেণীনন্দনও সেখানে উপস্থিত, এবং প্রত্যেকেই নানা সংশয়ে আক্রান্ত। বল্লভাচার্য ও বেণীনন্দনের উপস্থিতি স্পষ্টই বলে দেয় বর্তমান নাটক চাঁদ বণিকের পালা দিয়ে কতটা প্রভাবিত, বিশেষ করে যেখানে চাঁদ বণিকের পালা কোনোদিন মঞ্চস্থই হয়নি। চরিত্ররা তাদের প্রিয় পরিচালক সম্পর্কে নানা প্রশ্ন নিয়ে আজ উপস্থিত। কোনও প্রশ্ন তাদের আজকের যুগে অস্তিত্ব নিয়ে, কোনও প্রশ্ন আবার পরিচালকের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও, তাঁর বিশ্বাস নিয়েও। এই দৃশ্যটি দর্শককে টেনে নিয়ে চলে যায় গত শতাব্দীর ষাটের দশকে, যখন নান্দীকার গোষ্ঠী প্রযোজিত Pirandello-র নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র বাংলা নাট্য জগতে সাড়া তুলেছিল। সেই নাটকের আদলেই চরিত্রগুলো যেন পরিচালকের কাছে দাবি তুলছে তাদের জীবন কাহিনির পরিণতি নিয়ে।
কেবল একটি তফাত এখানে আছে। পরিচালক জীবিত নেই, তাই তাঁর আত্মার সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করার আকুল প্রচেষ্টা। চরিত্রদের মনে নানা প্রশ্ন পরিচালকের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে, তাই যেন Pluto-র রাজ্য থেকে তাকে ধরে বেঁধে নিয়ে আসা হয়েছে। Pirandello-র গুরুত্বকে এখানে একেবারেই অবহেলা করা যায় না, কারণ শ্রী রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, যিনি নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্রর প্রযোজনার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন, তিনি শ্রী শম্ভু মিত্র নাটকের সাথেও ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত। আরও একটি কারণে রুদ্রপ্রসাদ বাবুকে এই নাটক থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। সত্তর কী আশির দশকে তাঁরই উদ্যোগে বেশ কয়েকটি গ্রুপ থিয়েটার গোষ্ঠী মিলিত ভাবে শম্ভু বাবুকে মঞ্চে উপস্থিত করতে পেরেছিল মুদ্রারাক্ষস ও গ্যালেলিও নাটকের প্রধান চরিত্র দুটির ভূমিকায়। আর সেই পুরোন প্রচেষ্টার মতই শ্রী শম্ভু মিত্র নাটকটিও একাধিক নাট্যগোষ্ঠীর সাহায্য পেয়েছে।
চরিত্রদের ডাকে সাড়া দিয়ে শেষ পর্যন্ত শ্রী শম্ভু মিত্র মঞ্চে আবির্ভূত হন পিছনে নৌকাটির উপর। এই আবির্ভাব প্রথম থেকেই আমাদের মনে করিয়ে দেয় শম্ভু বাবুর নিজের সৃষ্টি সেই চাঁদ বণিকের কথা, যিনি নিয়তির সঙ্গে লড়াই করে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর এই বার্তা সমস্ত নাটক জুড়ে বারংবার ফিরে ফিরে আসে অসংখ্য প্রশ্নর জবাবে। অন্তিম যে সিদ্ধান্তে শ্রী শম্ভু মিত্র এসে উপস্থিত হন তা হল চাঁদের মতই তিনি তাঁর উদ্দেশ্য কী সঠিক ভাবেই জানতেন, জানতেন না কেবল পথের নিশানা। উদ্দেশ্যটা অবশ্যই ছিল অন্তহীন শিল্পোৎকর্ষ, কিন্তু পার্থিব পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ, কুরুচিপূর্ণ আপোশের বাধায় ঢাকা। নাটকটি দেখে যেটুকু অনুধাবন করা যায়, আপোশ করার ফলে শম্ভু বাবুর শিল্প প্রয়াস চিড় খায়নি। কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে ঘা তিনি খেয়েছিলেন। নাট্য রঙ্গ এই ব্যাপারটিতে চরম আত্মসংযম দেখিয়েছে। শম্ভু মিত্রকে তারা অনন্যসাধারণ শিল্পীর সম্মান দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু Prometheus-এর মত অতিমানুষ তৈরি করার চেষ্টা করেনি। এক অসামান্য শিল্পীকেও নিয়তির খেলায় অতি সাধারণ মানুষের পর্যায়ে নেমে আসতে হয় এটা তারা প্রথম থেকেই মেনে নিয়েছে।
তবে যে ব্যাপারটা দেখে সমালোচনা কিছুটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে সেটা হল চাঁদ বণিকের দার্শনিক সমস্যাগুলো শম্ভু বাবুর একান্তই ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যার সঙ্গে মিশে গিয়েছে। উৎপল দত্তকে পুলিশ হেফাজত থেকে মুক্তি দেওয়ার আবেদন পত্রে তিনি কেন সই করেননি? কারণ যাই হোক, এটা বোধহয় নিজের শিল্পবোধের সঙ্গে আপোশ করার পর্যায়ে পড়ে না। আরও অনেক বিরক্তিকর প্রশ্ন তাঁর কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে সম্পর্কর বিষয়। এমন কী তৃপ্তি মিত্রর সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়িটাও ছাড় পায়নি এই নাটকে। অবশ্যই শম্ভু বাবুর শিল্প সত্ত্বাকে বাচিয়ে রাখার জন্য তৃপ্তি দেবীর বাণিজ্যিক মঞ্চে যোগদান করার উল্লেখ নাটকে রয়েছে। কিন্তু তাঁদের ছাড়াছাড়ির কাহিনিটা বড়ই শিশুসুলভ শুনতে লাগে, যদিও মঞ্চে সেটার উপস্থাপনা করা হয়েছে অসাধারণ নৈপুণ্যের সংগে। আর এইখানেই পূর্ববর্ণিত লেটার বক্সের প্রসঙ্গটা এসে যায়।
নাট্যকার জানাচ্ছেন যে পুতুল খেলা নাটকের শেষের দিকে, যেখানে শ্রীমতী মিত্র ‘আমি পরাণের সাথে খেলিব আজিকে মরণখেলা’ আবৃত্তি করছেন সেখানে একদিন মহড়ার সময় নাকি শম্ভু বাবুর সঙ্গে তাঁর মত বিরোধ হয়। কী এক কারণে শম্ভু বাবু তাঁর ডান হাতের তর্জনী দিয়ে একটি চাবির রিং ঘোরাতে শুরু করেন। ঠিক এই মুহূর্তে মঞ্চে অবস্থিত লেটার বক্সে একটি পোস্টম্যান এসে পুতুল খেলা নাটকের আদলে শরীরে কাঁটা জাগানো একখানা চিঠি ফেলে দিয়ে যায়। লেটার বক্সের গায়ে একটি আলো জ্বলে উঠে অসাধারণ নাটকীয়তার সৃষ্টি করে। পুতুল খেলা নাটকে লেটার বক্সটির গুরুত্ব ভোলা যায় না, কারণ সেখান থেকেই দর্শক হয়তো অনুমান করতে শুরু করে যে নায়ক নায়িকার সম্পর্ক ছিন্ন হতে চলেছে। আর শ্রী শম্ভু মিত্র নাটকে তৃপ্তি মিত্র আপত্তি তোলেন শম্ভু মিত্রর চাবি ঘোরানো নিয়ে। এমনটা নাকি আগে করা হত না, কিন্তু শম্ভু বাবু বলে ওঠেন তিনি পরিচালক, যেমন বলবেন তেমনই হবে। এই কথা শুনে তৃপ্তি মিত্র হন হন করে মহড়া ছেড়ে বেরিয়ে যান আর এখানেই তাঁর শম্ভু মিত্রর সঙ্গে সম্পর্কের ইতি! কোথায় যেন একটা গুরুচণ্ডালী দোষ এখানে বেরিয়ে আসে। একদিকে Ibsen-এর নাটকের নাটকীয়তা আর লেটার বক্সের বিভীষিকা, অন্যদিকে আঙুলে চাবি ঘোরানো। দুটোরই পরিণতি স্বামী স্ত্রীর বিচ্ছেদ। কিন্তু দুটি ঘটনার গাম্ভীর্য তুলনীয় নয় একেবারেই। আর যে ব্যাপারটা এখানে আরও দুঃখ জাগায় সেটা হল ‘আমি পরাণের কাছে’ কবিতার আবৃত্তি। যাঁরা তৃপ্তি মিত্রকে এই আবৃত্তি করতে শুনেছেন, তাঁরা শ্রী শম্ভু মিত্র নাটকের আবৃত্তিকে বোধহয় মেনে নিতে পারবেন না। তবে যে অভিনেত্রী আবৃত্তিটা করেছেন এই নাটকে, এমন হতেই পারে যে তিনি এতই অল্পবয়স্কা যে পুতুল খেলা নাটক স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। কিন্তু নাটকের পরিচালক অবশ্যই পুতুল খেলা দেখেছেন বলে ধরে নেওয়া যায়, কাজেই আবৃত্তিটা না উতরানোর দায়িত্ব মূলত তাঁরই।
গ্যালেলিও নাটকের অভিনয়ের সময় শোনা যায় নাট্য সমালোচক ধরণী ঘোষ ও শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রেক্ষাগৃহে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আর্টের সঙ্গে শম্ভু মিত্র আপোশ করেছিলেন কী করেননি এই প্রশ্নের সঙ্গে প্রেক্ষাগৃহে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল কী হয়নি তার সম্পর্ক আদৌ আছে কিনা সন্দেহ। আর কেন তাঁদের প্রতি এমন ব্যবহার করা হয়েছিল সেই আলোচনা যেন নাটকের মূল বক্তব্যকে কিছুটা ছোট করে দিয়েছে। দর্শকরা জানতে পারেন যে শমীক বাবু নাকি নাটক দেখতে আদৌ যাননি, অর্থাৎ গুজবে কান দেবেন না। আর ধরণী বাবুকে কেন ঢুকতে দেওয়া হয়নি সেটার কোনও ব্যাখ্যা শেষ অবধি পাওয়া গেল বলে মনে হয় না। হয়তো বা ব্যাখ্যার যোগ্য নয় ব্যাপারটা। এই সমস্ত মামুলি ঘটনা কি চাঁদ বণিক বা অয়েদিপাউসের ট্রাজেডির পাশে এনে হাজির করাটা ঠিক হল? তাছাড়া শম্ভু বাবুকে ঘিরে সমস্ত নাটক সংস্থাকে একত্রিত করার যে মহৎ প্রচেষ্টা রুদ্রপ্রসাদ বাবু করেছিলেন সেটা তো আদৌ সফল হয়নি। তাই কাকে সেই উদ্যমে ছাই ঢালতে দেওয়া হয়নি সেই আলোচনা শুনতে আজকের যুগের দর্শকদের আগ্রহ থাকার সম্ভাবনা কম। নাকি এটা রুদ্রপ্রসাদ বাবুর নিজেরই কোনও একটা আত্মজিজ্ঞাসার বহিঃপ্রকাশ?
অবশ্য এমন হতে পারে যে শেষ বিচারে শম্ভু বাবু একজন নিতান্ত সাধারণ মানুষও যে ছিলেন এটাই প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল। কেবল চাঁদ বণিকের আপোশহীন জীবনে ভবিতব্যর কাছে মার খাওয়ার পাশে শম্ভু বাবুর জীবনের এই অতি সামান্য ঘটনাগুলো হয়তো একটু হালকা করে দেয় নাটকটিকে। এতটা অতি সাধারণ মানুষের আসনে তাঁকে বসালে তাঁর শিল্প ভাবনার ক্ষেত্রে কোনও অসংগতি ছিল কিনা তার যথাযথ বিচার হয় না। তাঁর শিল্পী সত্ত্বার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সঙ্গে ধরণী ঘোষদের একেবারেই কোনও অবদান ছিল না বলেই মনে হয়।
নাটকে অভিনয়ের মান তেমন উঁচু দরের নয়। যদিও শ্রী সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় যে সামান্যতম মুনশিয়ানাও দেখাননি এমন বলা চলে না। Primeval শব্দটির বিশুদ্ধ উচ্চারণ শুনে মন ভরে গেল। কেবল জায়গায় জায়গায় যখন তিনি শম্ভু মিত্রর অয়েদিপাউস বা গ্যালেলিওর ঢঙে কর্কশ গলায় কথা বলেছেন তখন তাঁর অনেক সংলাপ প্রায় বোঝাই যায়নি। এমন হতে পারে যে তিনি একটি লুকোনো মাইক্রোফোন ব্যবহার করেছেন আর অডিও ব্যবস্থায় খুঁত ছিল। ফলে দর্শকের কাছে শম্ভু বাবুর অভিনয় শৈলীর স্মৃতি এই প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি বলেই মনে হয়। আজকের দর্শকদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা শম্ভু বাবুর মঞ্চাভিনয়ের সঙ্গে একেবারেই পরিচিত নন। তাঁরা এই গলায় বিকৃতি নিয়ে আসার ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারেননি নিশ্চয়ই। আর যাঁরা শম্ভু মিত্রকে এই কণ্ঠস্বর ব্যবহার করতে শুনেছেন, তাঁরাও মনে হয়না যে তাঁকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছেন। সেরকমই মঞ্চের বেদির উপর চিৎ হয়ে শুয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি সহকারে নিজের যন্ত্রণার অভিব্যক্তিটাও খুব একটা রেখাপাত করে না।
পার্শ্ব চরিত্রদের অভিনয় সম্পর্কে বলার প্রায় কিছুই নেই। কোনও উদীয়মান অভিনেতা অভিনেত্রীকে সেখানে দেখা যায়নি বলেই মনে হয়। অভিনয়ের ছোটখাটো নিয়ম কানুনগুলো অনেকে মানেননি। একজনের মুখের উপর আলো অন্যের মুখের উপর ছায়া ফেলছে এটা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব দেখা গেল। যুক্তাক্ষরের উচ্চারণে সমস্যা রয়েছে অনেকেরই। অন্তত শম্ভু বাবু নিজে যে এ ব্যাপারে নজর দিতেন তাতে সন্দেহ নেই। মূকাভিনয়ের দৃশ্যগুলিও মনে দাগ কাটে না। কেবলই সন্দেহ হয় যে অভিনয় শাস্ত্রে আরও অনেক শিক্ষা পাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে অধিকাংশ অভিনেতারই।
Oscar Wilde-এর একটি উক্তি বহুবার মনে জেগে উঠছিল। An artist is the creator of beautiful things. To reveal art and conceal the artist is art’s aim। নাট্যকার এই উক্তিতে বিশ্বাস করবেন এমন নাই হতে পারে। হয়তো সেই জন্যই নট শম্ভু মিত্রকে ব্যক্তি শম্ভু মিত্রর সঙ্গে বারবার মিশিয়ে ফেলা হয়েছে এই নাটকে। একটি দৃশ্যে উৎপল দত্ত ও শম্ভু মিত্রর ছবি পাশাপাশি রেখে তাঁদের মধ্যে কথোপকথন চালানো হয়। কথোপকথনের বিষয়বস্তু হয়তো গভীর, কিন্তু বর্তমান লেখক তার মর্ম বুঝতে সক্ষম হয়নি।
অভিনয় নৈপুণ্য যেমনই হোক না কেন, নাট্য রঙ্গের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। শম্ভু মিত্রর মত নাট্য জগতের এক প্রবাদপুরুষের নামে যে নাটক এবং তিনি নিজে না হলেও তাঁর আত্মা যেখানে একটি চরিত্র সেখানে, দর্শক হয়তো একটু বেশি আশা করে ফেলে। সেই আশা মেটানো প্রায় অসম্ভব। আবার এমনও হতে পারে যে প্রায় স্বর্গীয় সৌন্দর্যের পাশে একেবারেই অসুন্দরকে দাঁড় করিয়ে দেওয়াতেও নাটকের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে চাঁদ বণিকের পালাতে শম্ভু বাবু নিজেই চাঁদের অমানুষিক দৃঢ়তার পাশে বেহুলার অতি লঘু নওটঙ্কি নাচের কথা শুনিয়েছেন।
কাজেই এই নাটকের সম্পর্কে চট করে ভাল মন্দ বিচার করাটা সুবিচার হবে না। আশা করা যায় যে আরও অনেক অভিনয়ের পর অভিনেতাদের মানও বাড়বে। শম্ভু মিত্রর শোকার্ত আত্মা জানান বিদেশে John Gielgud-এর সম্পর্কে কত গবেষণা হয়েছে, কিন্তু আমরা শিশির ভাদুড়ি বা মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যকে ভুলে মেরে দিয়েছি। মঞ্চাভিনয় আজও প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা পায়নি। দু-একজন শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত বা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো উঠে এসেছেন ঠিকই। এই সামান্য কজনের উত্থানকে থিয়েটার সমাজের উত্থান বলে মনে করাটা ভুল হবে। ভবিষ্যতের পথ নির্দেশক তাঁরা কেউই হয়ে উঠতে পারেননি। আর এটা যে কতটা সত্যি তা সহজেই উপলব্ধি করা যায় অধিকাংশ চরিত্ররই অপটু অভিনয় ক্ষমতা থেকে। শম্ভু মিত্র বা উৎপল দত্তর নিজেদের প্রযোজনায় অতি ক্ষুদ্র চরিত্রেও অভিনয়গত ভুল ভ্রান্তি প্রায় থাকতই না। তাঁরা নিজেরা যেই চলে গেলেন, মঞ্চাভিনয়ের মান অনেকটাই কমে গেল। সেই জন্যই শ্রী শম্ভু মিত্র নাটকে মঞ্চকে যে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা দিতে বলা হয়েছে সে ব্যাপারটা প্রণিধানযোগ্য।
নাট্যকার, পরিচালক, মুখ্য অভিনেতা এবং সংশ্লিষ্ট অন্য সকলকে নাটকের শেষ দৃশ্যের জন্য তারিফ করতেই হয়। মঞ্চ জগতের আশার আলোটি তাঁরা জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা যে করবেন এমনই একটি প্রতিশ্রুতি দিয়ে নাটকটির সমাপ্তি। দাঁড়ীরা এগিয়ে গিয়ে চাঁদ বণিকের থেমে থাকা নৌকাটির দাঁড় টানতে শুরু করে পুনর্বার। গ্রিক পুরাণের Sisyphus-এর এ ব্যাপারে কী মতামত থাকতে পারে সে প্রশ্নটা স্বাভাবিক ভাবেই মনে এসে যায়। এসে যায় বিক্ষুব্ধ নানা চিন্তার উপর যেন একটি শান্তির প্রলেপ দিয়ে।
নাটক দেখে বেরিয়ে এসে অন্য একটি চিন্তাও হয়তো কারও কারও মনে জাগতে পারে। বিশেষ করে যেখানে নাটকে উৎপল দত্তকেও স্থান দেওয়া হয়েছে সেখানে art for art’s sake সমস্যার মুখোমুখি পড়ে উৎপল দত্ত কোন পথ বেছে নিয়েছিলেন তার অনুসন্ধানটাও যেন জরুরী হয়ে পড়ে। ইংরেজিতে শেক্সপীয়র দিয়ে নাট্য জীবনের শুরু। তখন তিনি Geoffrey Kendall-এর শিষ্য, Othello-র অভিনয় করে কিছু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এমন হতেই পারে যে তাঁর সাবলীল ইংরেজি বলার ধরণ দেখে পরিচালক মধু বোস মাইকেল মধুসূদনের চরিত্রে তাঁকে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু উৎপল বাবু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বুঝেছিলেন যে দেশে বসে বিদেশি ভাষায় অভিনয় করলে মানুষের মন পাওয়া যাবে না। আর বাঙালিদের সৌভাগ্য যে তিনি বাংলাতেই অভিনয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এটা মনে রাখার মত কথা, কারণ পরবর্তী জীবনে তিনি দেখিয়েছিলেন ইচ্ছে করলে কতটা সহজে হিন্দিতে মঞ্চাভিনয় করার সিদ্ধান্তও নিতে পারতেন। অবশ্য পরিস্থিতির কারণেও হয়তো তিনি বাংলাকেই বেছে নিয়েছিলেন। গোড়ার দিকে Shakespeare নিজেই বাংলায় অনুবাদ করে Macbeth, Othello, Julius Caesar, Twelfth Night ইত্যাদি মঞ্চস্থ করেছিলেন। অবশ্য তাঁর বাংলা Shakespeare-এর প্রযোজনা আধুনিক বাংলা মঞ্চের Shakespeare প্রযোজনার থেকে অনেকটাই অন্যরকম ছিল। মূল নাটকের প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল অটল, যেটা এ যুগে বিরল। আজকের Shakespeare-এর প্রযোজনায় কী সব অজ্ঞাত কারণে সুধীন দত্তর উটপাখীর দেখা মেলে, পার্ক স্ট্রিটের সরাইখানা গজিয়ে ওঠে, একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতিকে খুঁজে বেড়ানো হয়। উৎপল দত্ত বা শম্ভু মিত্র এই সমস্ত রাস্তায় চলেননি। তাই রাজা অয়েদিপাউস আজও বেঁচে, নীচের মহল কী শের আফগানও। অন্তত যাঁরা সেসব নাটক দেখেছিলেন তাঁদের কাছে। Moscow Art Theatre-এর Othello কী Hamlet সম্পর্কেও সেই একই কথা বলা চলে। Stanislavsky-ও ইংরেজিতে Shakespeare অভিনয় করেননি, কিন্তু Shakespeare দিয়ে খিচুড়ি তৈরি করার চেষ্টাও তাঁর কাজে খুঁজে পাওয়া যায় না।
এই সমস্ত কথাগুলো প্রায় জোর করেই ধরে আনা হল কারণ শম্ভু বাবুর মত উৎপল বাবুকেও নিশ্চয়ই আর্টের সঙ্গে সমঝোতা করতে হয়েছিল। এই ব্যাপারটাই হয়তো শ্রী শম্ভু মিত্র নাটকেও উঠে এসেছে সেই দৃশ্যে যেখানে এই অসাধারণ দুই ব্যক্তিত্বের ছবিরা তাদের মতামত ব্যক্ত করে। অবশ্য প্রবন্ধের শুরুর দিকেই জানানো গিয়েছে যে দৃশ্যটির বক্তব্য এই লেখক সঠিক অনুধাবন করতে পারেনি। তবে দৃশ্যটি মনে অবশ্যম্ভাবী কিছু চিন্তা জাগিয়েছে। শম্ভু বাবু তাঁর আর্টের সঙ্গে আপোশ করেননি বটে কিন্তু নাটক জানাচ্ছে যে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে আপোশ ছিল, যদিও এই লেখকের মতে সেই সব ঘটনা তাঁর মহান আর্টের সঙ্গে আপোশের পর্যায়ে পড়ে না। শিল্পীর আপোশকে খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁর শিল্পের মধ্যেই। আর এই ব্যাপারটাই হয়তো ঘটেছিল উৎপল বাবুর মঞ্চ প্রযোজনায়। নট হিসেবে কারও চেয়ে কম না হয়েও মঞ্চে সেট, আলো ইত্যাদির গুরুত্বও উৎপল বাবু দিয়েছিলেন তাঁর সমসাময়িক অনেকের চেয়ে বেশি। একটু তুলনা করে দেখা যাক। অঙ্গার নাটকে ভূগর্ভস্থিত কয়লাখনির সেট তৈরি করার কথা কী কোনোদিনও শম্ভু বাবু চিন্তা করতেন? অঙ্গার নাটকের কথাটাই বিশেষ করে মনে জাগল, কারণ রক্তকরবী নাটকে চাইলেই এই জাতীয় কিছু একটা তিনি পরিবেশন করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। সেখানেও সেট ছিল, কেবল অঙ্গারের তুলনায় সে একেবারেই নগণ্য। সেই নাটকেও শ্রমিক শ্রেণীর শোষণের দৃশ্য ছিল, অথচ সেট ছিল অল্প, অভিনয়ই ছিল আসল। এদিকে অঙ্গার নাটকে শেষ দৃশ্যে আলোর সাহায্যে মঞ্চ জলে ভাসিয়ে দিয়ে সে যুগের লিট্ল থিয়েটার গ্রুপ চমক জাগিয়েছিল।
আর ঠিক এই জায়গাতেই আর্টের সঙ্গে আপোশ চলে এসেছিল। প্রায় প্রতি শো-তেই প্রেক্ষাগৃহ থাকত পূর্ণ। যে প্রশ্নটা স্বাভাবিক ভাবেই মনে জাগে তা হল দর্শকরা কী দেখতে আসতেন? অভিনয় না মঞ্চ জলে ভেসে যাওয়ার ম্যাজিক? রক্তকরবী নাটকে কিন্তু কোনও সন্দেহই নেই যে দর্শকদের টানত শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্রর অভিনয়। তার মানে এমন নয় যে অঙ্গার নাটকে উৎপল বাবু বা রবি ঘোষের (তখনও তিনি লিট্ল থিয়েটার ছাড়েননি) অভিনয় দেখে মানুষ মুগ্ধ হয়নি। শুধু মুগ্ধ হওয়াটা ছিল পাঁচ মিশেলি। পি সি সরকারের ম্যাজিকের সঙ্গে উৎপল দত্তর অভিনয়ের mixed grilled sandwich। আরও অনেক নাটকের কথাও মনে আসে। তিতাস একটি নদীর নাম নাটকে মেলার দৃশ্যের চমক, স্টেজের একাংশ প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে আসা। কল্লোল নাটকে একটা আস্ত জাহাজকে স্টেজে নিয়ে চলে আসা। কিংবা ভি আই পি নাটকে (যে নাটকে নায়ক ছিলেন হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়) স্টেজের পিছন দিয়ে গাড়ি চলার দৃশ্য। এরকম আরও অনেক উদাহরণই দেওয়া হয়তো চলে, তবে নাটকের সংখ্যা গোণাটা এখানে উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হল ভবিতব্যর সঙ্গে কে কেমন করে মোকাবিলা করেছিলেন সেটা বুঝবার চেষ্টা করা।
নাটক নিয়ে বেঁচে থাকতে গেলে, নাটককে বাঁচাতে গেলে দর্শক তো চাই। আর হয়তো বা সামান্য এক শতাংশ দর্শক ছাড়া সকলেই কিছুটা তামাসা দেখার আশায় নাটক দেখতে যান। শম্ভু বাবুর কৃতিত্ব তিনি এই তামাশাপ্রিয় দর্শকদের সঙ্গে হাত মেলাননি। আর সেইখানেই তৃপ্তি মিত্রর বিপুল অবদান। শম্ভু বাবুর আপোশবিহীন আর্টকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তিনি নিজে পেশাদারি মঞ্চে যোগদান করেছিলেন। এবং শ্রী শম্ভু মিত্র নাটক তৃপ্তি মিত্রর এই অবদানকে সঠিক ভাবেই তুলে ধরেছে। আর পরবর্তী কালে শম্ভু বাবু প্রায় একাকীত্বকেই বেছে নিলেন, কিছুটা শারীরিক কারণে নিশ্চয়ই, হয়তো আরও বেশি শিল্পের সম্পর্কে তাঁর অচল বিশ্বাসের কারণেই।
তাহলে উৎপল দত্তকে আমরা কী চোখে দেখব? তিনি কি থিয়েটারকে সার্কাসে রূপান্তরিত করলেন? অভিনয়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে? এমনটা মনে করলে তাঁর প্রতি বিরাট অবিচার করা হবে। প্রথম, দর্শক টেনে আনার জন্য তিনি যতই সেটের ম্যাজিক দেখিয়ে থাকুন না কেন, রবি ঘোষের মত অভিনেতা কিন্তু তাঁরই হাতে গড়া। দ্বিতীয়, হাজার সেট এবং আলোর খেলার মধ্য থেকেও উৎপল দত্তর একেবারেই অনন্যসাধারণ অভিনয় প্রতিভা ফুটে বেরিয়ে আসত আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের জিনের মত। পরবর্তী কালে ব্যাপারটা আরও বোঝা গেল বলিউডের একেবারেই বাজারি সিনেমার জগতে। উৎপল দত্ত বুঝেছিলেন যে থিয়েটারটা কেবল জ্ঞানীগুণীদের জন্য তৈরি করা দেওয়ানি খাস নয়। এখানে আম আদমিরাই বেশি ভিড় করে আসে আর তাদেরকে খুশি করতে না পারলে থিয়েটারের চাকা যাবে থমকে। এদিকে তাঁর নাটকে খাস আদমিদের জন্যও জায়গা থাকত। তাঁর অভিনয় শৈলীই ছিল খাস আদমিদের নজর কাড়ার হাতিয়ার। যেখানে শম্ভু বাবু তাঁর বুদ্ধিজীবী অস্তিত্বর সঙ্গে নাটককে আলাদা করতে চাইলেন না আর সেই প্রবল ইচ্ছাপূরণের জন্য তৃপ্তি মিত্র পেশাদারি মঞ্চে যোগদান করলেন, উৎপল দত্ত সেখানে একেবারে অন্য পথে চললেন। যে থিয়েটার তিনি তৈরি করলেন সেটা সকলের জন্য। আর সেই কথাটাই তো তিনি বলে গেলেন শেষ অবধি টিনের তলোয়ার নাটকে। “কলকেতার তলায়” থাকা মানুষের জন্যও তো নাটক করার দরকার কারণ তারাই তো সংখ্যাগুরু। তারা না থাকলে নাটকই থাকবে না। তাঁর নাটকে সেইজন্যই সূক্ষ্ম ও মোটা সব রকম দাগই থাকত। প্রয়োজনে ম্যাকবেথ, প্রয়োজনে বেণীমাধব চাটুজ্যে, প্রয়োজনে বলিউডের নরম গরম ছবির ভবানী শংকর! আমরা কী চোখে তাঁকে দেখব? একজন আপোশি মানুষ? নাকি এমন একজন অভিনেতা যাঁর প্রতিভা মহাসাগরের মতই কূলহীন? যিনি দর্শক টেনে আনার জন্য তাপস সেনের আলোর খেলাও যেমন দেখান, আবার সেই কলকেতার তলার মানুষদেরকেই বলেন Daily Mirror পত্রিকা তাঁকে বাংলার Garrick অভিধা দিয়েছে। নাটকের স্বার্থে নিজেরই হাতে তৈরি নায়িকাকে তুলে দেন ধনী পৃষ্ঠপোষকের হাতে, কিন্তু নাটককে ত্যাগ করেন না। যে কোনও মূল্যেই হোক নাটককে বাঁচাতেই হবে।
অবশ্য এমনটাও হতে পারে যে একবার বলিউডে সাফল্য পাওয়ার পর উৎপল দত্ত আর বাংলা মঞ্চর ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন বেশি উদ্বিগ্ন থাকেননি। আবার অন্য নিন্দুক বলবে Magsaysay Award পাওয়ার পর শম্ভু বাবুও মঞ্চ জগৎ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। নির্ভেজাল সত্যটুকু কোনোদিনই জানা যাবে না। তাই শ্রী শম্ভু মিত্র নাটক দেখার পর একটা প্রশ্ন বারবার মনকে নাড়া দিচ্ছে। আমরা কি কখনও শ্রী উৎপল দত্ত নামের কোনও নাটক দেখেতে পাব?
***
***