A KALEIDOSCOPE WORLD

ভগবানের জন্মদিন — অণুগল্প

ভগবান এত বুড়ো যে ভুলেই গিয়েছে কবে তার জন্মদিন। কেবল যে ভগবানকে তৈরি করেছিল তার শর্ত অনুসারে, ভগবান মরতে পারবে না। অবশ্য সে লোকটা যে কে তা ভগবান জানে না। ভগবান অনাথ, অথচ তার বিপুল ক্ষমতা।

এই ক্ষমতার জোরে ভগবান পৃথিবী বলে একটা জায়গা সৃষ্টি করল। পৃথিবী ভরিয়ে দিল হাজার হাজার জিনিসপত্রে। হেঁটে চলে বেড়ায় এমন জিনিসও ভগবান তৈরি করল। তারপর একদিন হঠাৎ মানুষ বলে এক জীব বানিয়ে ফেলল। মানুষ বানিয়ে অবধি ভগবান ভারি খুশি। কারণ একমাত্র মানুষরাই ভগবানকে দেখতে পায়। অবশ্য সব মানুষই যে এক ভাবে ভগবানকে দেখে তা নয়। পৃথিবীর নানা জায়গায় ভগবানের নানা আকৃতি। প্রকৃতিও। তবে ভগবান নিজে কোনোদিনও নিজেকে দেখেনি। ভগবান নিজেকে দেখার আয়না আবিষ্কার করতে পারে নি।

এদিকে মানুষ ভগবানকে দেখতে পায়। আর ভগবান সম্পর্কে মানুষ একটা জবর খবর রাখে। খবরটা হল ভগবান চাইলে সব কিছু করতে পারে। যত শক্ত কাজই হোক, ভগবান করতে পারে। সব সময় যে ভগবান মানুষের ইচ্ছে মত কাজকর্ম করে দেয় এমন না। অনেক মানুষ আছে যারা পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে চায়। তারা রাতদিন ভগবানের পুজো করে, ফুল বেল পাতা দিয়ে। যাদের পয়সা কড়ি আছে তারা মন্দির বানিয়ে তার ভিতর ভগবানকে আরাম কেদারায় বসিয়ে রাখে। কিন্তু আসল সময় দেখা যায় ভগবান তাদের সেকন্ড বা থার্ড করে দেয়। কী কারণে অন্য কাউকে ফার্স্ট করে দেয় কে জানে।

অনেকে মরতে চায় না। ভগবান তাদের কথাও শোনে না। ভগবান অতি স্বার্থপর। নিজে অমর থেকে বাকি সকলকে নশ্বর বানিয়েছে। এটা যে ঘোর অবিচার তা জেনেও হাজার কোটি লোক ভগবানের কাছে আম, জাম, লিচু, দই, সন্দেশ, সুন্দরী বউ, গাড়ি,বাড়ি কেবল চেয়েই যায়।

এমন করে অনন্ত কাল কেটে গেল। ভগবানের ভাণ্ডার থেকে রোজই অজস্র কিছু জিনিসপত্র অজস্র মানুষদের দিতে হয়। সর্বক্ষণ। প্রত্যেক মুহূর্তে। যেখানেই মানুষ জেগে আছে সেখানেই ভগবানের উপস্থিত থাকা প্রয়োজন। আর পৃথিবীর সর্বত্র সব সময় কেউ কেউ না কেউ জেগে থাকে। পৃথিবী তৈরি করার সময় ভগবান এটা খেয়াল করে নি যে মানুষ যদি সর্বক্ষণ জেগে থাকে তবে ভগবানের ঘুমোবার সময় থাকে না। ঘুম পেলেও ঘুমোরার জো নেই। হাই তুলতে তুলতে মানুষদের আবদার শুনতে হয়। তারপর ভাবতে হয় কোন আবদার রাখবে, কোন আবদার রাখবে না। যাদের আবদার মেটে না তারা মাঝে মাঝে ভগবানকে গালমন্দও করে। অভিশাপ দেয়। সেটাও ভগবানকে শুনতে হয়।

গালাগাল শুনতে শুনতে একদিন ভগবান গেল ভীষণ চটে। ভাবল — আমি জন্মালাম কেন? সবাই মরে, আমি মরি না। যাচ্ছেতাই।

তারপর নানা চিন্তা করে মানুষকে জব্দ করার একটা উপায় বের করে ফেলল। ভগবান নিয়ম করল তাকে আর পুজো করা চলবে না। মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরুদ্বার আরও যেখানে যেখানে পুজো করা হয় সব কিছু বন্ধ করে দিল। ভগবানের কাছে কিছু চাওয়ার কোনও পথ রইল না।

আসলে অনেকদিন ধরে ভগবান কিছু তৈরি করে নি। এবার হঠাৎ এক মারাত্মক অস্ত্র বানিয়ে ফেলল। মানুষ তার নাম দিল করোনা। করোনা মানুষকে ধরলেই চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। আর ভগবান মরতে চাইলেও, মানুষ কিছুতেই মরতে চায় না। আবার করোনাকে মানুষ কাবুও করতে পারে না। কেবল একটা ব্যাপার বোঝা গেল। করোনার থেকে দূরে থাকতে গেলে মানুষের থেকেও দূরে থাকতে হবে। নইলে একটা মানুষকে চিবোতে চিবোতে কাছাকাছি মানুষের উপরেও লাফিয়ে পড়ে করোনা তাকে চিবোতে পারে। ভগবান এই ভাবেই করোনা তৈরি করল।

এটা দারুণ বুদ্ধির খেলা। কারণ মন্দিরগুলোতে, গির্জাগুলোতে, মসজিদগুলোতে মানুষের বেজায় ভিড়। ঠাসাঠাসি,গাদাগাদি। সকলেই ভগবানের কাছে আগে আগে আবেদনপত্র জমা দিতে মারামারি করছে। এদিকে করোনা তো ভগবান সর্বত্র ছড়িয়ে রেখেছে। ধাক্কাধাক্কি করতে গিয়ে মানুষরা একে অপরের থেকে দূরে থাকা ভুলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে করোনা মানুষের মধ্যে ঢুকে তাদের বেঁচে থাকার রাস্তা বন্ধ করে দেয়।

শেষ অবধি মানুষ বুঝতে পারল যে বাঁচতে হলে একা একা বাঁচতে হবে। সকলে মন্দির টন্দির ছেড়ে পালাল। ঘরের ভিতর লুকিয়ে বসে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। মানুষের লক্ষ কোটি চাহিদার কথা আর মনেই রইল না। সকলের মনের মধ্যে একটাই চাহিদা। ফার্স্ট হতে চাই না, নামধাম চাই না, টাকা পয়সা চাই না। শুধু বেঁচে থাকতে চাই। বেঁচে থাকার চেয়ে মধুর কিছু নেই।

ভগবানের ভাণ্ডার জিনিস দিতে দিতে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। আর সেই ভাণ্ডারে মানুষের অমরত্ব কোনোদিনই ছিল না। তাই মানুষকে দেবার মত ভগবানের কাছে কিছুই রইল না। এবং আস্তে আস্তে কোনো না কোনো কারণে সমস্ত মানুষই মৃত্যুবরণ করল। কেউ করোনায়। কেউ অন্য রোগে, লুকিয়ে থাকা ডাক্তার বদ্যির খোঁজ না পেয়ে। কেউ অনাহারে।

শেষ মানুষটা মরে যাওয়ার পর ভগবান বড় খুশি হল। ফিক করে হেসে নিজেই নিজেকে বলল — আজ আমার জন্মদিন। হ্যাপি বার্থ-ডে টু ইউ।

%d bloggers like this: