রাস্তার মোড়ে ফুটপাতে বসেছিল। কুচকুচে কালো জামা, কুচকুচে কালো হাফ প্যান্ট। ছেঁড়াখোঁড়া। হাত পা মুখ, ঝাঁকড়া, ঝাঁকড়া চুল, দাড়ি গোঁফ। সব কুচকুচে কালো। আসলে হয়তো লোকটা ফরসাই। সতেরো বছর স্নান করে নি।
আমাকে দেখেই ফিক করে হাসল। ঝকঝকে সাদা দাঁত। চোখ দুটোও ধবধবে সাদা। বলল – এই শোন, খুব লজ্জা করছে। আমি চলেই যাচ্ছিলাম। পাগল ভেবে।
ও আবার বলল – খুব লজ্জা করছে রে।
আমি থেমে গিয়ে ওর দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলাম মিনিট খানেক। তারপর বললাম – কেন?
ও আবার ফিক করে হেসে বলল — এই ভিক্ষে চাইতে। ভিক্ষে দিবি? আগে আমি ভিক্ষে করতাম না। সত্যি বলছি মাইরি।
বললাম – কী করতে?
লোকটা খুব গম্ভীর হয়ে কী সব ভাবল। তারপর আবার আগের মত ফিক করে হেসে বলল — সত্যি বলছি মাইরি। মনে নেই। কিচ্ছু মনে নেই। সে অনেকদিন আগের কথা। তখন মানুষ ছিলাম।
সময় নষ্ট না করে ওকে একটা দশ টাকার নোট দিয়ে আবার হাঁটা লাগালাম।
ও মহা চেঁচামেচি শুরু করল। – ওরে আশীর্বাদ নিয়ে যা, আশীর্বাদ নিয়ে যা।
চমকে পিছন ফিরে তাকালাম। দেখি ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো দেখিয়ে হাসছে। হাসতে হাসতে প্রায় লুটিয়ে পড়ল।
– শোন, আশীর্বাদ নিয়ে যা। তুই বড় ভাল লোক। আশীর্বাদ করছি, পরের জন্মে তুই একটা ফুল হয়ে জন্মাবি।
বললাম – সে কী? ফুল হয়ে জন্মালে তো দু-তিন দিনের বেশি বাঁচবই না।
সে বলল – সেটাই তো চাই।
চলে যাচ্ছি, সে আবার ডাকাডাকি শুরু করল।
– বেশি বাঁচতে চাস? আচ্ছা অন্য আশীর্বাদ দিচ্ছি। তুই পরের বার একটা গাছ হয়ে জন্মাবি।
বললাম – এটা একটা কথা হল! কোথায় না কোথায় দাঁড়িয়ে থাকব, আর গরুতে খেয়ে নেবে। রাখ তোমার আশীর্বাদ।
– না, না। গরুতে খাবে না। তোর চারপাশে একটা বেড়া থাকবে। গরু খাবে না।
-বেড়াটা দেবে কে? তুমি?
– দুত্তোর! আমি বেড়া দেব কেন? যার বাড়ির উঠোনে তুই জন্মাবি সেই বেড়া দেবে।
– বাবা, উঠোন, বেড়া কত কিছু। তা বাড়ির মালিকটা কে হবে শুনি।
হো হো করে হেসে উঠল সে।
– বুঝেছি রে বুঝেছি। তোর মালিক হওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। ঠিক আছে তুই মালিক হবি। তখন তোকে গরুতে খাবে না।
– বাঃ, ভাল কথা।
– কিন্তু বাঘে খাবে।
– অ্যাঁ — বল কী? আশীর্বাদ করে আমাকে বাঘের পেটে পাঠাচ্ছ?
– তা যা বলেছিস। তুই লোক ভাল। তোকে বাঘে খাবে না।
-তাই? ঠিক জান তো?
– তোকে বাঘে খাবে না। তোকে মানুষেই খাবে। তুই লোক ভাল। তাই তোকে মানুষে খাবে। আগের জন্মে আমি যখন মানুষ ছিলাম, তখন আমাকেও খেয়েছিল।
এবার আর দাঁড়ালাম না।